বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক: সম্প্রতি একাধিক জাতীয় পত্রিকা এ মর্মে একটি ভুয়া, বিভ্রান্তিকর খবর ছেপেছে যে আধুনিক গণতন্ত্রের সূতিকাগার ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ২৯ মার্চ এনআরবি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হবে ডা. জাফরুল্লাহকে এবং হাউস অব কমন্সে এ পুরস্কার গ্রহণের জন্য তিনি লন্ডন চলে গেছেন। পত্রিকাগুলোর দোষ নয়, এ অসত্য এবং বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারী খবরটি তাদের কাছে পাঠিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রেস উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু। এটি পরিষ্কার যে মিন্টুর পাঠানো তথ্যটি সত্যের ইচ্ছাকৃত অপলাপ মানুষের মধ্যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে। এ তথ্যটি নিশ্চিতভাবে ডা. জাফরুল্লাহর জন্যও বিব্রতকর। হাউস অব কমন্স ডা. জাফরুল্লাহকে কোনো সম্মাননা দেওয়ার কথাটি শুধু সর্বৈব বানোয়াটই নয়, উদ্ভটও বটে। ডা. জাফরুল্লাহ এমন কিছু করেননি যার জন্য তাঁকে হাউস অব কমন্স সম্মাননা দিতে পারে।
আসল ঘটনা হলো আবুল হাসনাত নামক লন্ডনপ্রবাসী এক ব্যক্তি, যে তারেক রহমানের উপদেষ্টা, তিনিই দিচ্ছেন এ সম্মাননা হাউস অব কমন্সে একটি রুম ভাড়া করে। যে কোনো ব্যক্তি একজন ব্রিটিশ এমপির সাহায্যে হাউস অব কমন্সে রুম ভাড়া করতে পারে, আর সেই ভাড়া করা রুম থেকে সম্মাননা দেওয়া মানে হাউস অব কমন্স কর্তৃক সম্মাননা দেওয়া নয়। খবরটি আমাকে প্রথম জানিয়েছিলেন জাতির বিবেকতুল্য আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রোগশয্যা থেকেই টেলিফোন করে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলেছিলেন হাসনাত নামক তারেক রহমানের উপদেষ্টা ‘ভয়েস ফর গ্লোবাল বাংলাদেশিজ’ নামক একটি সংস্থা তৈরি করে কজন ব্যক্তিকে হাউস অব কমন্সে একটি রুম ভাড়া করে সম্মাননা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন, যাতে কিছু মুক্তিযোদ্ধা থাকলেও বেশির ভাগ থাকবে তারা হাসনাত সাহেব যাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করবেন, যাদের অনেকেই রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। গাফ্ফার চৌধুরী জানালেন এ হাসনাত যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধা ড. নুরুন্নবিকে ওই বৈঠকের বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করেছেন এবং তিনি হাসনাতের পরিচয় এবং অনুষ্ঠানের আদ্যোপান্ত না জেনেই প্রথম লন্ডনে যেতে সম্মত হয়েছিলেন। তবে পরে গাফ্ফার চৌধুরী ড. নুরুন্নবিকে সব ফাঁস করে দিলে তিনি লন্ডনে আসার পরিকল্পনা ত্যাগ করেছেন বলে গাফ্ফার চৌধুরী এবং যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগপ্রধান সুলতান শরিফকে জানিয়েছেন। গাফ্ফার চৌধুরী যুক্তরাজ্যে আমাদের হাইকমিশনার সাঈদা মুনাকে বলেছেন কোনো বৈঠক বন্ধ করার ক্ষমতা তো তাঁর নেই। তাঁকেও নিমন্ত্রণ করা হয়েছে, তবে তাঁর যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। গাফ্ফার চৌধুরী, সুলতান শরিফ, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাকাউন্ট্যান্ট সৈয়দ মোজাম্মেল আলী এবং যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত শহীদ সিরাজুদ্দিন হোসেনের ছেলেকে জানালে তাঁরা আসল ঘটনা জেনে যান। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে একজন যুবক বয়সী হওয়া সত্ত্বেও এই ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে যাননি। তা ছাড়া সে বছর তিনি প্রবাসে ছিলেন না বলে প্রবাসে কারা স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তা তার জানার কথা নয়। তদুপরি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, শেখ আবদুল মান্নান, আবদুল মতিন, মাহমুদ এ রৌফ এবং ড. খন্দকার মোশাররফের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তি, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে বিলেতে মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁদের লেখা বইগুলোয় যেসব নাম রয়েছে সে নামগুলোর অধিকাংশই এ ব্যক্তির প্রকাশিত তালিকায় নেই। লন্ডনে বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর টকশোয় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ এমনকি বঙ্গবন্ধুর নিন্দায়ও কথার ঝড় তোলেন, বন্দনা করেন তারেক রহমান, খালেদা জিয়া এবং জিয়াউর রহমানের। এক টকশোয় তিনি সর্বজনশ্রদ্ধেয় গাফ্ফার চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে বেয়াদবি করার মতো ধৃষ্টতা দেখানোর পর গাফ্ফার চৌধুরী তার সঙ্গে টকশোয় যাওয়া বন্ধ করেছেন। এ বিষয়ে গাফ্ফার চৌধুরী সম্প্রতি একটি জাতীয় পত্রিকায় বিস্তারিত লিখেছেন। উল্লেখ্য, যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা তকমা দেওয়া রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মতো অপরাধ। তবে তার রাজনৈতিক গুরু জিয়াউর রহমানও অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা বেআইনিভাবে দখল করেছিল।
নানান বিতর্কের পরেও একটি সত্য কথা হচ্ছে, ড. জাফরুল্লাহ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে তাঁর অনেক বিতর্কিত বক্তব্য এবং কর্মকাণ্ডের পরেও আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করি। তাঁর কী প্রয়োজন ছিল এ ধরনের একটি ভুয়া সম্মেলন থেকে ফালতু একটি তথাকথিত সম্মাননা গ্রহণ করা, যাতে তাঁর সম্মানহানিই ঘটবে। পুরো বিষয়টি না জানলে তাঁর উচিত ছিল তথ্য সংগ্রহ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া আর গণস্বাস্থ্যের প্রেস উপদেষ্টা মিন্টু যা বলেছেন তা বলার আগে তারও নিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সম্মাননা সত্যি সত্যিই হাউস অব কমন্স দেবে কি না। তিনি হয়তো জানেন না অথবা জেনেশুনেই বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য এ তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু না জানার বিষয় সম্বন্ধে খোঁজ নেওয়া নিশ্চয়ই প্রেস উপদেষ্টার একটি মৌলিক দায়িত্ব। তার বোঝা উচিত ছিল এ ধরনের চতুরতামূলক তথ্য ঢাকা থাকবে না। স্টিফেন টিমস নামক ব্রিটিশ সংসদ সদস্য হাসনাতের অনুরোধেই হাউস অব কমন্সের রুম ভাড়া করতে সাহায্য করেছিলেন। ব্রিটিশ এমপিরা কমিউনিটিতে মোটামুটি সুপরিচিত লোকদের দাবিতে প্রতিনিয়ত এটি করেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সৈয়দ মোজাম্মেল যিনি স্টাডি সেন্টার নামক একটি গবেষণা সংস্থার প্রধান, তিনি বেশ কয়েকবার এমপিদের সাহায্যে হাউস অব কমন্সে রুম ভাড়া করেছিলেন, যার বেশ কটিতে আমিও উপস্থিত ছিলাম। আরও অনেক বাঙালি এভাবে হাউস অব কমন্সে রুম ভাড়া করেছেন। কয়েক সপ্তাহ আগে বিএনপি মহাসচিব এ মর্মে একটি খবর প্রচার করেছিলেন যে খালেদা জিয়াকে কানাডার এক সংস্থা একটি সম্মানজনক পদক দিচ্ছে। কিন্তু তার পরপরই সেই তথাকথিত পদকের গোমর ফাঁস হয়ে গেল, জানা গেল একটি ফালতু, নামসর্বস্ব সংস্থা খালেদা জিয়াকে তিন বছর আগে এটি দিয়েছিল। মির্জা ফখরুলের সে প্রচারণা তাঁকে এবং তাঁর নেত্রীকে মহাবিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল যখন আসল ঘটনাটি ফাঁস হয়ে যায়।
একটি কথা মনে পড়ল। প্রায় দুই দশক আগে বাংলাদেশের জনৈক বিত্তশালী লোক একটি অনলাইন পিএইচডি সার্টিফিকেট কিনে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা ইমপেরিয়াল কলেজের অডিটোরিয়াম ভাড়া করে সেখানেই সেই ভুয়া সার্টিফিকেট প্রদানের ব্যবস্থা করেছিল জনগণকে এ মর্মে বিভ্রান্ত করার জন্য যে সার্টিফিকেটটি ইমপেরিয়াল কলেজই প্রদান করেছে। ডা. জাফরুল্লাহর ব্যাপারেও একই বিভ্রান্তিমূলক কাজটি করা হয়েছে। হাউস অব কমন্স কাউকে সম্মাননা দিতে হলে সেই মর্মে প্রস্তাব গ্রহণ করতে হয়, আর সম্মাননা প্রদান করতে পারেন হাউস অব কমন্সের স্পিকার বা হাউস অব লর্ডসের লর্ড চ্যান্সেলর অথবা তাঁদের দ্বারা দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি। কোনো এমপিই হাউস অব কমন্সের পক্ষে কাউকে সম্মাননা দিতে পারেন না, স্পিকারের থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হয়ে। সুতরাং যে এমপির কথা বলা হয়েছে তাঁর কোনো ক্ষমতাই নেই ডা. জাফরুল্লাহ অথবা অন্য কাউকে হাউস অব কমন্সের হয়ে সম্মাননা প্রদান করার। এ এমপি যা করছেন তা হলো তাঁর নামেই হাউস অব কমন্সের রুমটি ভাড়া করা হয়েছে এবং সম্ভবত তিনি সেই তথাকথিত সম্মাননা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। এ বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করে তথ্য পাঠিয়েছেন গণস্বাস্থ্যের প্রেস উপদেষ্টা যাতে জনগণ মনে করে হাউস অব কমন্সই ডা. জাফরুল্লাহকে পুরস্কার দিচ্ছেন। এ ধরনের নিন্দনীয় পদক্ষেপকে অবশ্যই ধিকৃতি জানাতে হবে যেন তারা এ ধরনের বিভ্রান্তিকর খবর দিয়ে জনগণকে ধোঁকা দিতে না পারে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক সম্মাননা সেটিই যেটি ২০০৪ সালে তৎকালীন লর্ড চ্যান্সেলর, লর্ড চার্লি দিয়েছিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে, যখন তিনি বিরোধী দলের নেত্রী। লন্ডনে অবস্থিত ব্রিটিশ হাই কোর্টের বিশাল ব্যাংকোয়েট হলে বহু ব্রিটিশ মন্ত্রীসহ পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের শতাধিক সদস্য উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন বোন শেখ রেহানা এবং যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের কিছু শীর্ষ নেতা। আমারও অপার সৌভাগ্য হয়েছিল সে অনুষ্ঠানে অতিথি হওয়ার।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন